শিশুর সঠিক বিকাশে বাবা-মায়ের ৭টি অপরিহার্য দায়িত্ব
শিশুর জন্ম একটি নতুন জীবনের সূচনা, আর এই জীবন গঠনের মূল ভিত হল সঠিক যত্ন, ভালোবাসা ও দিকনির্দেশনা। একটি শিশু জন্মের পর থেকেই কেবল খাওয়া-পরা নয়, তার মানসিক, শারীরিক ও নৈতিক বিকাশের দায়িত্বও প্রধানত বাবা-মায়ের ওপর নির্ভর করে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, অধিকাংশ সময় মায়ের দায়িত্বকেই পরিবারে প্রাধান্য দেয়া হয়, তবে শিশুর পূর্ণাঙ্গ বিকাশে বাবা ও মা উভয়ের অংশগ্রহণ সমান গুরুত্বপূর্ণ।
শিশুর বিকাশ বলতে কী বোঝানো হয়?
শারীরিক, মানসিক, নৈতিক ও সামাজিকভাবে শিশু যেন সমভাবে বেড়ে ওঠে, সেটিকে সঠিক বিকাশ বলা হয়। এই বিকাশ শিশুদের পরবর্তীকালে একজন ভালো মানুষ, সফল নাগরিক ও নৈতিকতা-সম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করে। ভুল দিকনির্দেশনা, পরিবারিক কলহ ও অবহেলা শিশুকে বিপথে পরিচালিত করতে পারে।

শিশুর বিকাশে বাবা-মায়ের প্রধান ভূমিকা কী কী?
১. সুষম ও নিরাপদ পারিবারিক পরিবেশ তৈরি
শিশু তার চারপাশ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। বাবা-মায়ের সুন্দর সম্পর্ক, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ শিশুর সামনে একটি সৌম্য-চরিত্রের আদর্শ তৈরি করে।
পারিবারিক কলহ, উচ্চস্বরে ঝগড়া, মায়ের প্রতি অবহেলা শিশুর মানসিক বিকাশে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শিশুর চোখে বাবা-মা পৃথিবীর কেন্দ্র—তাদের সম্পর্ক যদি অস্থির হয়, তাহলে শিশু নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে।
২. বন্ধুসুলভ সম্পর্ক গড়ে তোলা
শিশু যেন তার অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে, ভুল করলে ভয় না পেয়ে শেয়ার করতে পারে—এই পরিবেশ তিনিই তৈরি করতে পারেন যিনি তার সঙ্গে বন্ধু হয়ে থাকেন।
প্রতিদিন অন্তত ১৫ মিনিট সময় দিন শুধুমাত্র তার কথা শোনার জন্য। জানুন তার স্কুলের গল্প, বন্ধুদের কথা, চাওয়া-পাওয়ার ভাবনা। এটি তার আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করবে।
৩. অহেতুক মানসিক চাপ থেকে বিরত থাকা
অনেক বাবা-মা মনে করেন, পরীক্ষায় ভালো ফল না করলে বা হোমওয়ার্ক ঠিকভাবে না করলে চাপ প্রয়োগ করা উচিত। অথচ এটি লোকচক্ষুর সামনে শিশুকে সফল করলেও, ভিতর থেকে ধ্বংস করে দেয়।
শিশুদের শেখাতে হবে শিখতে ভালোবাসা, প্রতিযোগীতা নয়, সহযোগিতাকে গুরুত্ব দেওয়া এবং ব্যর্থতা থেকে শিখে সামনে এগিয়ে যাওয়া।
৪. নৈতিক শিক্ষা ও আচরণ শিক্ষা
শিশুদের মধ্যে ন্যায়-অন্যায় বোঝার জ্ঞান ছোটবেলা থেকে গড়ে তুলতে হবে। কারো প্রতি সহানুভূতি, ধৈর্য, ক্ষমাশীলতা ও শ্রদ্ধাবোধ—এই শিক্ষাগুলো বাবা-মায়ের আচরণ থেকেই শেখে।
শিশুর কাছে আদর্শ শুধু বইয়ের চরিত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; মা-বাবার প্রতিদিনকার আচরণই সবচেয়ে বাস্তব উদাহরণ।
৫. উন্নয়নমূলক ও সাংস্কৃতিক চর্চার সুযোগ দেওয়া
স্কুলের পড়া ছাড়াও শিশুকে দিন শিশুতোষ গল্প, কবিতা, সাধারণ জ্ঞানভিত্তিক বই পড়ার সুযোগ। তাকে নাচ, গান, চিত্রাঙ্কন ইত্যাদিতে উৎসাহ দিন। এতে মানসিক বিকাশ ও সৃজনশীলতা বাড়বে।
৬. বাবার সক্রিয় উপস্থিতি নিশ্চিত করা
বাংলাদেশে সাধারণত বাবা অর্থ উপার্জনের ভূমিকা পালন করলেও শিশুর বিকাশে তার মানসিক উপস্থিতিও জরুরি।
শিশু যখন বাবার সঙ্গে খেলাধুলা করে, গল্প শোনে বা সময় কাটায়, তখন তার মধ্যে নিরাপত্তাবোধ বাড়ে। বাবারা কেবল “শাসক” হিসেবে নয় বরং “সহচর” হিসেবে যত বেশি থাকবেন, শিশুর আত্মবিশ্বাসও তত বাড়বে।
৭. গর্ভকালীন যত্ন ও মানসিক প্রস্তুতি
শিশুর বিকাশ শুরু হয় গর্ভকাল থেকেই। একজন মায়ের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতিফলন পড়ে ভ্রূণের ওপর।
গর্ভকালীন সময়ে পরিবারের সমর্থন বিশেষ করে স্বামীর সহানুভূতি, মানসিক প্রশান্তি, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা শিশুর সুস্থ জন্ম এবং পরবর্তী বিকাশে বড় প্রভাব রাখে।
শিশুর বিকাশ ব্যাহত হওয়ার কারণ
পারিবারিক কলহ, অবহেলা, মানসিক নির্যাতন
অতি কঠোর শাসন কিংবা অতিরিক্ত প্রশ্রয়
শিশুকে সময় না দেওয়া বা সম্পর্কহীনতা
স্কুল, বন্ধু বা সমাজে নেতিবাচক প্রভাব
মা-বাবার ব্যস্ততা এবং সন্তানের প্রতি উদাসীনতা
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে ১৮% শিশু কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত। বহু ক্ষেত্রেই এই সবের মূল কারণ পরিবার থেকে শুরু হয়।
শিশুর বিকাশে বাবা-মায়ের জন্য কার্যকর করণীয়: সংক্ষিপ্ত চেকলিস্ট
করণীয় | ব্যাখ্যা |
---|---|
বন্ধুসুলভ সম্পর্ক গঠন | শিশুর সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করুন |
সময় দিন মানসিকভাবে | শুধু খাবার-দাবার নয়, সময় দিন খেলায়, গল্পে |
সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীলতায় উৎসাহ | গান, ছবি আঁকা, বই পড়া—সবই প্রয়োজন |
গর্ভকালীন সুশ্রুষা | ভবিষ্যতের সুস্থ সন্তানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ |
কঠোরতা এড়িয়ে সুলভ শাসন | ভালো বলার মাধ্যমেও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা সম্ভব |
সমান দায়িত্ব শিকার | বাবা এবং মা উভয়ের পক্ষ থেকেই যত্ন প্রয়োজন |
নিজের আচরণ পরিশুদ্ধ করা | আচার-আচরণেই শেখে শিশুর নৈতিকতা |
উপসংহার
“আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ।”
একজন শিশু কেমন মানুষ হবে, তা নির্ধারণ হয় তার বেড়ে ওঠার পরিবেশ, অভিভাবকদের আচরণ, ভাষা, ভালোবাসা, শিক্ষা এবং দিকনির্দেশনার ওপর। সঠিক পথে গড়ার জন্য শিশুকে কেবল বইয়ের শিক্ষা নয়, জীবনের শিক্ষা দিতে হবে—আর সেটি শুরু হয় পরিবার থেকে।
শিশুর সঠিক বিকাশে বাবা-মায়ের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বন্ধুসুলভ, যত্নবান, দায়িত্বশীল, এবং ভালোবাসায় পূর্ণ সম্পর্কই গড়ে তুলতে পারে এক আদর্শ প্রজন্ম।